পুরান ঢাকার Biryani ইতিহাস জানতে হলে আমাদের ফিরে যেতে হবে প্রায় চারশ বছর আগে মোগল শাসনামলে। ষোড়শ ও সপ্তদশ শতাব্দীতে যখন ঢাকা সুবাহ বাংলার রাজধানী ছিল, তখন থেকেই এই অঞ্চলে বিরিয়ানির জনপ্রিয়তা শুরু হয়। মোগল সম্রাটদের বিভিন্ন মুখরোচক খাবারের প্রতি ছিল অসীম আগ্রহ ও দুর্বলতা, আর সেই সূত্রেই বাংলার মাটিতে আসে বিরিয়ানির মতো অসাধারণ খাবার।
১৬০৮ থেকে ১৭১৭ সাল পর্যন্ত ঢাকা বাংলা সুবাহের রাজধানী হিসেবে ১৬১০ সালে সুবেদার ইসলাম খান চিশতি দায়িত্ব পালন করেছে। এই সময়ের মধ্যে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিক প্রয়োজনে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে মানুষ ঢাকায় আসতে শুরু করে।মোগল শাসকদের সাথে তাদের খাদ্য সংস্কৃতিও আসে। ফারসি, তুর্কি এবং আরবি প্রভাবিত রন্ধনশৈলী ধীরে ধীরে স্থানীয় বাঙালি খাদ্য সংস্কৃতির সাথে মিশে যায়।
পুরান ঢাকার জনপ্রিয় বিরিয়ানির ধরন
হাজীর বিরিয়ানি

পুরান ঢাকার সবচেয়ে বিখ্যাত ও প্রাচীনতম বিরিয়ানির দোকান হলো হাজির বিরিয়ানি। ১৯৩৯ সালে হাজি মোহাম্মদ হোসেন মাত্র এক হাঁড়ি বিরিয়ানি নিয়ে এই ব্যবসা শুরু করেন। খাবারের মান ও অসাধারণ স্বাদের কারণে দ্রুতই ছড়িয়ে পড়ে হাজির বিরিয়ানির সুনাম।
পরবর্তীতে তার ছেলে হাজি গোলাম হোসেন এবং বর্তমানে নাতি হাজি মোহাম্মদ সাহেদ হুসাইন বংশপরম্পরায় এই ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন। প্রায় তিন প্রজন্ম ধরে একই রেসিপি ও মান বজায় রেখে হাজির বিরিয়ানি আজও ঢাকাবাসীর হৃদয়ে রাজত্ব করছে।
হাজির বিরিয়ানির বিশেষত্ব হলো তারা গরুর মাংসের পরিবর্তে শুধুমাত্র খাসির মাংস ব্যবহার করেন। তেলের ক্ষেত্রেও তারা ঘি বা বাটারের বদলে দেশীয় সরিষার তেল ব্যবহার করেন। সম্পূর্ণ দেশীয় মসলার ব্যবহার করে এখনও মাটির পাত্রে রান্না করার ঐতিহ্য ধরে রেখেছেন তারা। ঐতিহ্য রক্ষার জন্য কাঁঠাল পাতায় বানানো প্লেটে পরিবেশন করা হয় হাজির বিরিয়ানি|
“২০২5 সালে হাজীর বিরিয়ানি আবার নতুন ব্রাঞ্চ খুলেছে গুলিস্তানে…”
হানিফ বিরিয়ানি:
১৯৭৫ সালে হাজি মোহাম্মদ হানিফ প্রতিষ্ঠা করেন হানিফ বিরিয়ানি। মজার ব্যাপার হলো, এই দোকানটি গড়ে উঠেছে হাজির বিরিয়ানির ঠিক বিপরীতেই। হাজির বিরিয়ানির পাশে টিকে থাকতে হানিফকে খুবই মানসম্মত ও স্বাদযুক্ত বিরিয়ানি তৈরি করতে হয়েছে।
২০০৫ সালে হাজি হানিফের মৃত্যুর পর তার ছেলে হাজি মোহাম্মদ ইব্রাহিম রনি ব্যবসার দায়িত্ব নেন। বর্তমানে ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় হানিফ বিরিয়ানির একাধিক শাখা রয়েছে। তাদের প্রধান আকর্ষণ খাসির কাচ্চি বিরিয়ানি।
হাজি নান্না বিরিয়ানি:
১৯৬২ সালে পুরান ঢাকার বাবুর্চি হাজি নান্না মিয়া শুরু করেন হাজি নান্না বিরিয়ানি। প্রথমে তিনি মোরগ পোলাও দিয়ে ব্যবসা শুরু করেন, পরে যুক্ত হয় কাচ্চি বিরিয়ানি। খাসির কাচ্চি বিরিয়ানি ভোজনরসিকদের কাছে বেশ জনপ্রিয়। প্রতি মাসের পাঁচ তারিখে আস্ত মোরগের বিরিয়ানি বিক্রি হয় এই দোকানে, যা খুবই জনপ্রিয়।
কাচ্চি বিরিয়ানি:
১৯৯০ সালের দিকে ঢাকায় কাচ্চি বিরিয়ানির জনপ্রিয়তা ছড়িয়ে দেয় পুরান ঢাকার বিখ্যাত হাজী মোহাম্মদ হাশেম আলী।তিনি এই রেসিপি বাণিজ্যিকভাবে পরিবেশন শুরু করেন। আজ সেই ঐতিহ্য বহন করছে তাঁর পরবর্তী প্রজন্ম, আর কাচ্চি বিরিয়ানি হয়ে উঠেছে ঢাকার সবচেয়ে পরিচিত ও প্রিয় খাবারগুলোর একটি।
উপকরণের বিশেষত্ব
পুরান ঢাকার বিরিয়ানিতে বিশেষ কিছু উপকরণ ব্যবহার করা হয় যা এর স্বাদকে অনন্য করে তোলে:
- সুগন্ধি চাল: বাসমতি বা পোলাও চাল ব্যবহার করা হয় যা বিরিয়ানির টেক্সচার ও সুগন্ধ বাড়ায়|
- খাসির মাংস: বেশিরভাগ ক্ষেত্রে খাসির মাংস ব্যবহার করা হয় কারণ এটি দ্রুত সিদ্ধ হয় ও স্বাদে অতুলনীয়|
- টক দই: মাংসকে নরম ও রসালো করতে টক দই ব্যবহার করা হয়|
- বিশেষ মসলা: এলাচ, দারচিনি, লবঙ্গ, জায়ফল, জিরা এবং গরম মসলার বিশেষ মিশ্রণ|
- সরিষার তেল: অনেক ঐতিহাসিক দোকান ঘি বা বাটারের বদলে দেশীয় সরিষার তেল ব্যবহার করে|
- জাফরান ও গোলাপজল: রঙ ও সুগন্ধের জন্য এগুলো অপরিহার্য|
স্বাস্থ্য উপকারিতা

যদিও বিরিয়ানি একটি সমৃদ্ধ খাবার, সঠিক পরিমাণে খেলে এর রয়েছে বেশ কিছু উপকারিতা —
- protein এর উৎস: গরু বা খাসির মাংস শরীরের কোষ মেরামত ও শক্তি বৃদ্ধিতে সাহায্য করে।
- অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট উপাদান: এলাচ, দারচিনি ও জাফরান রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়।
- এনার্জি বুস্টার: চাল ও ঘি শরীরকে তাত্ক্ষণিক শক্তি দেয়।
- মানসিক তৃপ্তি: ঘ্রাণ ও স্বাদ মনকে প্রফুল্ল করে, যা মানসিক প্রশান্তিতে সাহায্য করে।
ঐতিহ্য সংরক্ষণ: প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে
পুরান ঢাকার সবচেয়ে প্রসিদ্ধ ও প্রাচীন বিরিয়ানির দোকান হল হাজির বিরিয়ানি। ১৯৩৯ সালে হাজি মোহাম্মদ হোসেন মাত্র এক হাঁড়ি বিরিয়ানি নিয়ে এই ব্যবসা শুরু করেন। খাবারের গুণমান ও অসাধারণ স্বাদের জন্য দ্রুতই হাজির বিরিয়ানির সুনাম ছড়িয়ে পড়ে।
পরবর্তীতে তার ছেলে হাজি গোলাম হোসেন এবং বর্তমানে নাতি হাজি মোহাম্মদ সাহেদ হুসাইন বংশপরম্পরায় এই ব্যবসা পরিচালনা করছেন। প্রায় তিন প্রজন্ম ধরে একই রেসিপি ও মান বজায় রেখে হাজির বিরিয়ানি আজও ঢাকাবাসীর হৃদয়ে রাজত্ব করছে।
পুরান ঢাকার বিরিয়ানি: সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপট
পুরান ঢাকার বিরিয়ানি শুধু একটি খাবার নয়, এটি সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনেরও এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। বিয়েবাড়ি, খৎনা অনুষ্ঠান, ঈদ, জন্মদিন কিংবা যেকোনো পারিবারিক অনুষ্ঠানে পুরান ঢাকায় বিরিয়ানি অপরিহার্য। বিশেষ করে Ramadan মাসে ইফতারের সময় পুরান ঢাকার বিরিয়ানি দোকানগুলোতে উপচে পড়া ভিড় দেখা যায়।
কাজী আলাউদ্দিন রোড, নাজিমুদ্দিন রোড, উর্দু রোড, বংশাল, সিদ্দিকবাজার, চকবাজার, নবাবপুর, ইসলামপুর, ওয়ারী, মালিটোলা এবং মৌলভীবাজার এলাকায় বিরিয়ানির দোকানগুলোতে প্রতিদিন ঢাকার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মানুষ ছুটে আসেন। শুধু ঢাকা নয়, দেশের বিভিন্ন জেলা থেকেও পর্যটকরা আসেন পুরান ঢাকার বিরিয়ানির স্বাদ নিতে।
চ্যালেঞ্জ ও ভবিষ্যৎ
তবে এই ঐতিহ্য রক্ষার পথও সহজ নয়। আধুনিকায়ন, জায়গা সংকট, পরিবেশ দূষণ এবং পুরান ঢাকার অবকাঠামোগত সমস্যা এই ব্যবসায়ীদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। তবে মানুষের ভালোবাসা ও ভোজনরসিকতাই এই ব্যবসাকে টিকিয়ে রাখার প্রধান চালিকা শক্তি।
সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে পুরান ঢাকার এই খাদ্য ঐতিহ্য সংরক্ষণের উদ্যোগ প্রয়োজন। এই ঐতিহাসিক দোকানগুলোকে স্বীকৃতি দেওয়া, পরিচ্ছন্নতা ও স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত করা এবং পর্যটকদের জন্য সুবিধা বৃদ্ধি করা জরুরি।
উপসংহার: শুধু খাবার নয়, এক জীবন্ত ইতিহাস
পুরান ঢাকার বিরিয়ানি শুধু একটি খাবার নয়, এটি চারশ বছরের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির এক জীবন্ত উদাহরণ। মোগল সাম্রাজ্যের হাত ধরে আসা এই খাবার কালক্রমে বাংলাদেশের নিজস্ব সংস্কৃতির অংশ হয়ে উঠেছে।
হাজির বিরিয়ানি, হানিফ বিরিয়ানি, নান্না বিরিয়ানি এবং আরও অনেক প্রতিষ্ঠান দশকের পর দশক ধরে রক্ষা করে চলেছেন এই ঐতিহ্য। মাটির হাঁড়ি, কাঠের চুলা, খাসির মাংস, বিশেষ বিরিয়ানি মসলা (species)এর মিশ্রণ – এসব মিলে তৈরি হয় এক অসাধারণ স্বাদের অভিজ্ঞতা যা একবার চাখলে জীবনভর মনে থেকে যায়।
পুরান ঢাকার সংকীর্ণ অলিগলি আর সেই গলিতে ভেসে আসা বিরিয়ানির ঘ্রাণ – এই দৃশ্য বাংলাদেশের খাদ্য সংস্কৃতির এক অনন্য চিত্র। এই ঐতিহ্য আমাদের সবার দায়িত্ব সযত্নে রক্ষা করা, যাতে ভবিষ্যৎ প্রজন্মও উপভোগ করতে পারে পুরান ঢাকার বিরিয়ানির অতুলনীয় স্বাদ ও ঐতিহ্য।
আরও রেসিপির জন্য চোখ রাখুন: Runnar Hut

[…] বাংলার খাদ্য সংস্কৃতি শুধুমাত্র স্বাদের নয়, বরং হাজার বছরের ইতিহাস, ঐতিহ্য এবং সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের এক অনন্য সমন্বয়। ভৌগোলিক অবস্থান, জলবায়ু এবং বিভিন্ন সভ্যতার প্রভাবে বাংলার রান্নাঘর হয়ে উঠেছে এক সমৃদ্ধ খাদ্য ভান্ডার। আজকের এই নিবন্ধে আমরা জানবো বাংলার জনপ্রিয় খাবারের ইতিহাস। […]